বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৪৭): ঈশ্বরের গল্প

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

আমি এখানে যে লেখালেখি করি তার বেশিরভাগই বেরিয়ে আসে বন্ধুবান্ধব বা ছেলেমেয়েদের সাথে গল্প করে অথবা ফেসবুকে কোন স্ট্যাটাস পড়ে। ওদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যেসব ভাবনা মাথায় আসে পরে সেটাকেই লিখিত রূপ দেই। এটা অনেকটা কলিগদের সাথে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হবার মত। তবে কলিগদের সাথে কথায় যদি আগে থেকেই বিষয়বস্তু কমবেশি ঠিক করা থাকে, ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলার সময় সেটা হয় না। ওরা আমার সাথে কথা বলতে চাইলে সাধারণত ঘুরতে যেতে চায়। কারণ বাসায় মানে টুকিটাকি বিভিন্ন ধরণের কাজ আর বাইরে গেলে আমি মঝে মধ্যে দু চারটে ছবি তুলি, বাকী সময় কাটে বিভিন্ন গল্পে। সেটা বিভিন্ন বিষয়েই হতে পারে। হতে পারে ওদের কোন সমস্যা নিয়ে কথা বা কোন বিষয়ে ওদের আগ্রহ বা অনাগ্রহ নিয়ে। আজ সেরকম একটি দিনের গল্প করে চাই।

গত সপ্তাহে মনিকা আগে থেকেই বলে রেখেছিল আমি যেন ক্যামেরা নিয়ে আসি। ছবি তুলতে যাবে। আসলে আমি এমনিতেই প্রায়ই ক্যামেরা নিয়ে যাই মস্কো, তবে কোন ধরণের ছবি তুলব সেটার উপর নির্ভর করে লেন্স নিই। বিশেষ করে ওরা ছবি তুলতে না চাইলে পোরট্রেট লেন্স অযথা টানি না। ইচ্ছে ছিল সেন্টারে কিছু ছবি তোলা। সেন্টারে অনেক পুরানো ও ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে, ওগুলো খুব ভাল ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে কাজ করে। যাহোক, দুবনা থেকে এসে একটু ফ্রেশ হয়ে বেরুলাম। মনিকাকে বার বার জিজ্ঞেস করলাম কার্ড ও অন্যান্য কাগজপত্র, চাবি সব আছে কিনা। মেট্রোর সামনে এসে দেখল সব বাসায় ফেলে এসেছে। ওর আবার অন্য এক প্রোগ্রাম। তাই আমরা বাড়ির আশেপাশেই ঘুরে কিছু ছবি তুললাম। ও চলে গেল কাজে। আমি বাসায়। কিছুক্ষণ পরে সেভা ফিরলে বললাম ঘুরতে যেতে।

ইদানিং কালে বেশিক্ষণ হাঁটলে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সেটা অবশ্য আমার পায়ের সমস্যা। সেভা জিজ্ঞেস করল
তোমার কষ্ট হচ্ছে?
একটু। ধীরে ধীরে যাই চল।
তারচেয়ে বরং চল দোকানে যাই। কাল দুবনা ফেরার আগে আবহাওয়া ভালো থাকলে তোমাকে নিয়ে নিস্কুচনি সাদে যাব।
আসলে সন্ধ্যার পরে ওখান থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, মস্কো নদীর তীর দেখতে বেশ লাগে। বিশেষ করে যখন নদীর উপর এসব বিল্ডিঙের আলোর প্রতিচ্ছবি পড়ে।

চল, তাহলে দোকানেই যাই।
দোকানে রাতের জন্য খাবার কিনে ফিরছি। ইউনস্ত হোটেলের সামনে এসে বলল
বসবে এখানে?
এই হোটেলে সোভিয়েত আমলে ছাত্র ইউনিয়ন ও যুব ইউনিয়নের নেতারা এসে থাকতেন। কতবার যে গেছি। কত স্মৃতি। সব মিলিয়ে ঠিক করলাম একটু বসে যাই।

পাপ, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
অবশ্যই করবি।
তোমার কি মনে হয়, ঈশ্বর আছেন?
হঠাৎ এই প্রশ্ন?

আমি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম। সেভার সাথে আমার রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলা, মিউজিক, সাহিত্য বিভিন্ন বিষয় নিয়েই কথা হয়। তবে ধর্ম নিয়ে ওর কোন আগ্রহ কখনোই দেখিনি। ছাত্রজীবনে আমি মিউজিক শুনতে খুব পছন্দ করতাম, বিশেষ করে ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিকাল। বিটলস, পিঙ্ক ফ্লয়েড, ডোরজ এসবও ছিল। এখন দেখি ও প্রায়ই এসব মিউজিক শোনে আর ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক। প্রায়ই আমার প্রিয় গ্রুপের মিউজিক। অথচ কখনোই আমি ওকে এসব ব্যাপারে বলিনি।
না, মানে একটি ভিডিও দেখলাম। ওখানে বলল, ঈশ্বর আছে এটা ধরে নিলে জীবনে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়।
তা হয়। আমরা যেসব প্রশ্নের উত্তর জানি না বা যেসব সমস্যা সামাধান করতে কোন উপায় খুঁজে পাই না সেসব যদি কারো ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া যায় তাতে নিজেকে আর মাথা ঘামাতে হয় না। তাই বিশ্বাসের যে কোন প্র্যাক্টিক্যাল দিক নেই তা নয়। তবে অধিকাংশ মানুষ হয় নিজের ব্যর্থতা ঈশ্বরের কাঁধে চাপিয়ে দেয় নয়তো ঈশ্বরের নামে বিভিন্ন কুকাজ করে। তাই সবকিছুর মত এর ভালো ও মন্দ দুটো দিকই আছে।
আমরা হোটেলের সামনে বসে গল্প করছিলাম আর প্রায়ই আমি কল্পনায় চলে যাচ্ছিলাম ওদের ছোটবেলায়।
আমারও মনে হয় ঈশ্বর ব্যাপারটা একেবারেই মানুষের তৈরি।
সেটা বলতে পারিস। আসলে যাকিছু প্রকৃতিতে নেই প্রায় সে সবই মানুষের তৈরি, কল্পনার ফসল। কিছু কিছু কল্পনা আমরা বাস্তবে রূপ দিতে পারি, পেরেছি। আর কিছু কিছু কল্পনা আমাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। উল্টো সেসব কল্পনা বাস্তবের চেয়ে বড় হয়ে আমাদের উপর জেঁকে বসেছে। ফলে মানুষ আজ তার কল্পনার দাস।
তুমি কি কখনই ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে না?
করতাম। ছোটবেলায়।
তাই? বলবে সে সময়ের কথা?
দেখ, আমাদের ঈশ্বর একেবারেই অন্য রকম। তুই ঠিক বুঝবি না। হয়তো এ কারণেই বলে হিন্দু হয়ে জন্ম নিতে হয়, এটা হওয়া যায় না।
যেমন?
দেখ ধর্ম সম্পর্কে আমি বা আমরা জেনেছি গল্পের মাধ্যমে। রামায়ণ মহাভারতের গল্প শুনে। মনে আছে ছোটবেলায় আমি তোদের ইলিয়াড, অডিসি এসব পড়ে শুনাতাম?
ঠিক মনে পড়ছে না।
কেন? হারকিউলিসের গল্প পড়ে শুনাতাম সেটা মনে নেই? হারকিউলিসের বারোটি কৃতিত্বের কাহিনী?
হ্যাঁ। মনে পড়ছে। সাইক্লোপসের কথা মনে পড়ছে।
আমাদের দেবতারা বা ঈশ্বর এদের মতই। যখন খুশি স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নেমে আসত। মানুষের সাথে খেলাধুলা করত। আমাদের বাড়িতে দেবতাদের অনেক মূর্তি ও ছবি ছিল। ছবি মানে আইকন। আমরা ওদের সকালে ঘুম থেকে জাগাতাম, তিন বেলা খাওয়াতাম, রাতে আবার ঘুম পারাতাম যেমন ছোটবেলায় তোদের ঘুম পারাতাম। বা বলতে পারিস মনিকা ক্রিস্টিনা যেভাবে পুতুল নিয়ে খেলত। অনেক সময় মা আমাকে ওদের পূজা করতে বলতেন। পূজা মানে খাবার দেয়া। আমি নিজের পছন্দের খাবার বেশি বেশি ওদের দিতাম, কারণ জানতাম পরে আমি নিজেই এসব খাব। তাই দেবতারা ছিল আমার বন্ধুর মত, খেলার সাথী। মনে পড়ে যখন মনিকা লিজাদের সাথে গির্জায় যেত আমি ওকে বলতাম যীশুকে শুভেচ্ছা জানাতে?
হ্যাঁ, সবাই হাসত তোমার কথা শুনে।
জানি। আসলে আমার কাছে ঈশ্বর এমনি ছিল। এটা মনে হয় আমাদের ধর্মের কারণে। এ বিষয়ে ভিসোৎস্কি খুব ভালো বলেছেন – হিন্দুরা খুব সুন্দর একটা ধর্ম উদ্ভাবন করেছে। আসলেও তাই।
আর এখন? এখন তুমি বিশ্বাস কর?
ঈশ্বর আমার কাছে অনেকটা বন্ধুর মত। আমি তাঁকে বিরক্ত করি না, ঈশ্বরও আমাকে বিরক্ত করেন না। মানে এ নিয়ে আর ভাবি না। কারণ মহাবিশ্ব নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ, বাইরের সাহায্য ছাড়াই চলতে পারে।
কিন্তু এই যে ইলেকট্রন, প্রোটনের ওজন, বিভিন্ন কনস্ট্যান্টের মান – ওদের মান যদি একটু অন্যরকম হত তাহলে এই জীবজগৎ থাকত না, সব হত অন্যরকম। এটা কি কারো হস্তক্ষেপ ছাড়াই হয়েছে?
হ্যাঁ, সেটা ঠিক। তবে সবকিছুই তো এভাবেই হয়। এই দেখ একজন শিল্পী যখন ছবি আঁকে তখন সে একটু একটু করে সেটাকে নিখুঁত করে তোলে। প্রথম দিকের গাড়ি, প্লেন, কম্পিউটার এসবই এখনকার চেয়ে ভিন্ন। আমরা সব কিছু করি আমাদের সৃষ্টিকে স্থিতিশীলতা বা স্ট্যাবিলিটি দিতে। ডারউইনের তত্ত্বে সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট যার মূল কথা পরিবেশের সাথে যে খাপ খাইয়ে চলতে পারে সেই টিকে থাকে। মহাবিশ্বের উৎপত্তির পর যখন বিভিন্ন রকমের মৌলিক কণার উৎপত্তি ঘটে তখন তারা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নিলেও শুধু সেগুলোই টিকে আছে যাদের মান ঠিক এমনটা ছিল। তাই প্রশ্নটা কে এত নিখুঁত ভাবে এদের মান নির্ণয় করল তা নয়, বিভিন্ন মানের মধ্য থেকে সেগুলোই টিকে গেল যা ঐ পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিল। পৃথিবীতে আগেও বিভিন্ন রকমের প্রাণী ছিল, এমনকি আমাদের মানুষের অনেক জ্ঞাতি ভাই ছিল। কিন্তু তারা পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
তার মানে হিন্দু ধর্ম ভালো?
না, ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়। তবে সব ধর্ম এভাবে মানুষের উপর এক ধরণের দাগ কেটে যায়। দীর্ঘ দিন কোন কিছু করলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। তাই আমি ধর্ম মানি বা না মানি – ছোটবেলার সেই অভ্যেসগুলো রক্তে মিশে গেছে। অনেক কিছুই অবচেতনভাবে করি। সেদিক থেকে সেমেটিক মানে মধ্য প্রাচ্যে যেসব ধর্মের উৎপত্তি তা একেবারেই ভিন্ন। সেখানে ঈশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্ক একেবারেই ভিন্ন। তিনি মূলত বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন বা হন, বন্ধুর ভূমিকায় নয়। এটা ভালো মন্দের ব্যাপার নয়। এটা জীবন দর্শন। তবে ধর্মের পক্ষে সম্ভব হয়েছে মানুষকে জম্বি করে রাখা। এখন গণতন্ত্র, মানবতা এসবও তো মানুষকে জম্বি করে রাখছে। এই যে গণতন্ত্র মানেই আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্ব – সেটাও তো এক ধরণের অন্ধবিশ্বাস।
অন্ধবিশ্বাসই কী ধর্ম?
বলতে পারিস। কারণ ধর্মে প্রশ্নের সুযোগ খুব কম, বিশেষ করে সেমেটিক ধর্মে। ভারতীয় ধর্মে সেই জায়গাটা অনেক বেশি। মজার ব্যাপার হল ভারতীয় ধর্মে ঈশ্বরকে নিয়ে প্রশ্ন বা হাসিঠাট্টা করার সুযোগ থাকলেও ধর্মীয় রীতিনীতি, জাতপাত এসব নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ কম। উল্টো – সেমেটিক ধর্মে জাতপাতের বালাই না থাকলেও ঈশ্বরকে নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই বললেই চলে। তার সবারই ভালো মন্দ দুটো দিকই আছে। তবে ইদানিং কালে অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে। আর এর ফলে ধর্ম আরও বেশি রক্ষণশীল হচ্ছে।
ঠিক বুঝলাম না।
এই ধর এক সময় বাংলাদেশে কোন কোন বিষয় ছিল মূলত হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত – যেমন গায়ে হলুদ, ঢাকঢোল বাজিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা। আজকাল মুসলমান সমাজেও সেটা ঢুকে গেছে, যাচ্ছে। ফলে ধর্ম গেল ধর্ম গেল বলে সেখানে মৌলবাদ বাড়ছে। ঠিক একই ঘটনা ঘটছে হিন্দুদের মধ্যে। জাতপাতের বাধানিষেধ আগের মত নেই। খাবার দাবারের ব্যাপারেও অনেকেই অনেক লিবারেল। ফলে এখানেও অনেকেই ধর্মের ব্যাপারে খুব সংকীর্ণ হচ্ছে, ঠাকুর দেবতাদের নিয়ে কথা বললে অনেকেই সেটা ধর্মের অবমাননা হিসেবে দেখছে। সেভাবে দেখলে একদিকে যেমন দুই ধর্মের মধ্যে পরপস্পরের থেকে গ্রহণ করার প্রবনতা বাড়ছে, অন্যদিকে সেটাকে ঠেকানোর চেষ্টাও বাড়ছে। ধর্ম পরিবর্তন স্বীকার করে না, কিন্তু সেটা অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই সমস্যা ঈশ্বর থাকা না থাকার নয় – সমস্যা তাঁকে বা তাঁর ধারণা নিয়ে কে কোন পথে হাঁটবে, অন্যদের সাথে কি সম্পর্ক গড়ে তুলবে তাতে। যাকগে চল রাত হয়ে যাচ্ছে। ক্ষিদে পেয়েছে। রান্না করতে হবে।
চল।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো