বিজ্ঞান ভাবনা (১৪৫): যুদ্ধ –বিজন সাহা

হামাসের সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের পর প্রায় ছয় মাস কেটে গেল। এখনও যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ না বলে এটাকে একতরফা গনহত্যাই বলা চলে ইসরাইলের পক্ষ থেকে। প্রশ্ন হল এত বেসামরিক মৃত্যুর পরেও গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা নীরব কেন?
২০২২ সালে রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে তার অনেক আগে থেকে এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব ফলাও করে প্রচার চালাচ্ছিল আর রাশিয়াকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছিল। পরবর্তী ঘটনা থেকে আমরা জানি আসলে পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে এমন ভাবে সাজিয়েছিল বা সাজাচ্ছিল যে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করতে বাধ্য হয়। তাই ইউক্রেনের যুদ্ধটা ছিল অবশ্যম্ভাবী, এটাকে লাগানো হতই। রাশিয়াকে প্ররোচিত করে যুদ্ধ লাগানোর ফলে অন্তত প্রাথমিক ভাবে কিছুটা ডিপ্লোম্যাটিক চাপ সৃষ্টি করা গেছে, এখনও অনেক মানুষ যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকেই দায়ী করে থাকে ঘটনার বিস্তারিত না জেনে বা জানার চেষ্টা না করে। বর্তমান যুগে সঠিক ভাবে কোন ঘটনা জানা খুব বেশি কষ্টের ব্যাপার নয়, দরকার জানার ইচ্ছা ও কোন পক্ষের খবরে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে বিভিন্ন পক্ষ থেকে খবর সংগ্রহ করে নিজের বুদ্ধি দিয়ে সেটা বিশ্লেষণ করা, দেখা এই ঘটনায় কে লাভবান হচ্ছে। আর একবার সেটা বের করতে পারলে কে যুদ্ধটা লাগালো, কে ইন্ধন যোগাল সেটাও বের হয়ে আসবে। আজকাল সবচেয়ে বড় সমস্যা হল তথ্যের প্রাচুর্য ও সেটা থেকে সত্য বের করার জটিলতা। অনেক আগে থেকেই আমাদের মনে ঢুকে গেছে যে পশ্চিমা বড় বড় মিডিয়া হাউজ যা বলে সেটাই পরম সত্য। এসব মিডিয়া হাউজ যে অনেক আগেই সেসব দেশের সরকারের মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে বা কোন নির্দিষ্ট ধনকুবেরদের স্বার্থরক্ষার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে সেটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই এবং অভ্যেস বশত এদের সত্যের একমাত্র উৎস মনে করি। আসলে আমাদের সব দেশে আমরা যখন ধর্মের নামে অনেক কিছু জায়েজ করে নেই পশ্চিমা বিশ্ব তেমনি গণতন্ত্র আর মানবতার নামে তাদের সব কিছু জায়েজ করিয়ে নেয়। আর আমরা এসব গণতন্ত্রের বাণী শুনে তাদের কথাকেই সঠিক বলে মনে করি। এই তো গতকাল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিল, বলল এ যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাজিত করতেই হবে। তা না হলে সেটা হবে তাদের পরাজয়। এর পরেও কি আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় যুদ্ধটা আসলে কার? গতকালই বলা হল যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার গ্যাসের উপর তাদের নির্ভরতা ৪০% থেকে কমে ১৫% হয়েছে, কিন্তু এর ফলে বেড়েছে আমেরিকার উপর নির্ভরতা। আমেরিকান গ্যাস যে শুধু কয়েকগুণ ব্যয়বহুল তাই নয়, পরিবেশের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকারক। কিন্তু এই ইউরোপিয়ান ব্যুরোক্র্যাটরা, যারা কয়েক বছর আগেও গ্রীন এনার্জির পক্ষে জেহাদ ঘোষণা করেছে, আজ এসব গিলে যাচ্ছে। এই যুদ্ধের ফলে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশের অর্থনীতি আজ ক্ষতিগ্রস্থ, তাদের জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে, যদি টিভি ও নেটের সংবাদ সত্য হয়ে থাকে এসব দেশের অনেকে আজ খাবার কিনবে বা বাসা ভাড়া দেবে সেই ডিলেমায় দিন কাটাচ্ছে – তাহলে এটাকে আমরা গণতন্ত্র কিভাবে বলি? মনে রাখতে হবে রাশিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায় না, তারা সমঝোতায় আসতে চায়, চায় না এখানে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ মারা যাক, এমনকি সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে ভেবে শীতে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এরা আঘাত হানেনি, কিন্তু ইউরোপিয়ানরা যুদ্ধ চায়। কেন? কারণ এতে ইউরোপের ও আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসায়ীরা লাভবান হয়, তাদের কলের চাকা ঘুরে। আর এসব আমলারা, বিশেষ করে ইউরো ব্যুরোক্র্যাটরা এসব কোম্পানির ভারাটে সেনা। এরাই বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অজুহাতে যুদ্ধ লাগায় আর এসব কোম্পানিকে বিভিন্ন দেশের কন্ট্রাক্ট পাইয়ে দেয়। এটা অনেকটা আমাদের দেশের বিভিন্ন ডাক্তারের সাথে ওষুধ কোম্পানির, হাসপাতালের সাথে বিভিন্ন ল্যাবরেটারির চুক্তির মত।
যাহোক ফিরে আসি প্যালেস্টাইনে। প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি হলেও এবং এর নিজস্ব প্রসাশন থাকলেও এখনও পর্যন্ত সে জাতি সঙ্ঘের পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা লাভ করেনি। এই মুহূর্তে সে ব্যাপারে কাজ চলছে। তবে খুব সম্ভব যুক্তরাষ্ট্র সেটা হতে দেবে না, যদিও ঠিক এই মুহূর্তে কী বাইরে কী আমেরিকার ভেতরে প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দেবার পক্ষে চাপ আছে। এখানে কতগুলো প্রশ্ন মনে জাগে। যে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের আগে থেকে ঢাক ঢোল বাজিয়ে এ ব্যাপারে ফলাও করে প্রচার করেছে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা প্লাস মাসাদ কীভাবে হামাজের সম্ভাব্য আক্রমণ দেখতে পেল না? এটা কি ইচ্ছাকৃত? কারণ ইসরাইলের বর্তমান জঙ্গি মন্ত্রী সভা অনেক দিন থেকেই হামাজকে দমন করার পথ খুঁজছিল যেমন আমেরিকা খুঁজছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের নিষেধাজ্ঞা আরোপের অজুহাত। এটা কী ইচ্ছাকৃত নাকি হামাজকে আক্রমণ করতে প্রলোভিত করা যা আমরা বাইরে থেকে ঠিক জানি না। একই ঘটনা রাশিয়ার ক্ষেত্রেও ঘটেছে এবং প্রথমে তা বিশ্বাস না করলেও পরবর্তীতে পশ্চিমা নেতারাই স্বীকার করেছে যে তারা দীর্ঘ দিন ইউক্রেনকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছে। কেন? একটাই কারণ, যুদ্ধের পক্ষে নিজ নিজ দেশে জনমত তৈরি করা। মনে রাখতে হবে যে হামাজের সাথে ইরান জড়িত আর কী আমেরিকা, কী ইসরাইল – সব সময়ই সুযোগ খোঁজে ইরান আক্রমণ করার। আর সেটা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ইসরাইল সিরিয়ায় ইরানী দূতাবাসে আক্রমণ চালিয়ে দুই উচ্চপদস্থ সেনাপতিকে হত্যা করেছে। প্রতিশোধ হিসেবে ইরান ইসরাইলের উপর কয়েক শ ড্রোন হামলা চালিয়েছে। যদিও তাতে প্রানহানি হয়নি, তবে ইরানের আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল ইসরাইলকে জানানো যে সে ইরানের নাগালের মধ্যেই। এখন বল ইসরাইলের পায়ে। পরবর্তী ঘটনা কোন দিকে যাবে সেটা ইসরাইলের উপর নির্ভর করছে, যদিও আমেরিকা ইসরাইলকে এ ব্যাপারে সমর্থন করবে না বলে জানিয়েছে। তবে এটাও ঠিক ইরানের ড্রোন হামলা থেকে ইসরাইলকে রক্ষা করতে আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও ন্যাটোর কিছু কিছু দেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এখানে আবারও প্রমাণিত হয় আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ন্যায় অন্যায়ের চেয়েও বড় কথা এটা তাদের স্বার্থে নাকি স্বার্থের পরিপন্থী। সিরিয়ার যুদ্ধে রুশ সেনারা সিরিয়ার পাশে দাঁড়ানোর পর থেকেই আমেরিকা আরব বিশ্বে পায়ের নীচে মাটি হারাচ্ছিল। আরব বসন্তের ঢেউ অনেক আগেই থেমে গেছে। এমনকি সৌদি আরবের মত আমেরিকার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে এরা রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ তো করেইনি বরং ব্রিকসে যোগ দিয়ে রাশিয়াকে আইসোলেট করার পশ্চিমা চাল বানচাল করেছে। তাই বর্তমান যুদ্ধ আমেরিকার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন করে প্রবেশ করার দ্বার নতুন করে উন্মুক্ত করেছে। তাহলে কি হামাজের ইসরাইল বসতি আক্রমণের পেছনে আমেরিকার হাত ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা হয়তো কোন দিনই পাব না। তবে এর ফলে আমেরিকা এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে। প্রথমত রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পরে ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ায় তেল গ্যাস বর্জন করলে আমেরিকা সেই স্থান পূরণ করে ইউরোপের বাজার দখল করেছে। তাদের অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে। আবার মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ তাদের ইউরোপ থেকে বেরিয়ে যাবার অজুহাত তৈরি করেছে। এখন আমেরিকা নয়, মূলত ইউরোপ এই যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। অন্য দিকে মধ্য প্রাচ্যে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করার সুযোগ এসেছে। ওদিকে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে চলছে নতুন খেলা। প্রাকৃতিক দুর্যোগএক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। তাইওয়ানের চিপ তৈরির কারখানার এক বিরাট অংশ মেক্সিকোতে নতুন ঠিকানা নিয়েছে।
আমাদের এক মন্ত্রী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতেন। তবে গ্লোবালাইজেশনের ফলে বিশ্ব আজ বাংলাদেশের চেয়েও ছোট, আর ইউক্রেন, মধ্যপ্রাচ্য, তাইওয়ান এসব একই সূত্রে গাঁথা। কয়েক শ বছর আগে পশ্চিমা বিশ্ব বাইবেল আর বিজ্ঞান হাতে এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকায় গিয়ে তাদের বশ্যতা মানতে বাধ্য করেছে। এখন এসব কাজ করছে গণতন্ত্র আর মানবতার নামে। মাও সে তুং বলেছিলেন বিড়ালের কী রং সেটা বড় কথা নয়, সে ইঁদুর ধরতে পারে কিনা সেটাই আসল কথা। কোন দেবীর পূজা করবে সেটা বড় কথা নয়, সেটা অন্যদের অধীনে রাখার, অন্যদের শোষণ করার সুযোগ করে দেবে কিনা সেটাই দেখবার বিষয়।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো