তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করে আলোচনায় বাংলাদেশি কূটনীতিক

ইরানে বাংলাদেশি দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ওয়ালিদ ইসলামের একটি ফেসবুক পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যেখানে তিনি দাবি করেছেন, সমাজে টিকে থাকার জন্যই দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে লুকিয়ে রেখেছিলেন নিজের তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়।
বিয়ে করতে অস্ত্রোপচার করে হতে চেয়েছিলেন নারী। সফল হয়নি সেই অপারেশন। সেখান থেকে বাঁধে ক্যান্সার। ভেঙ্গে যায় বিয়ে।
বিবিসি বাংলাকে এই কূটনীতিক বলেছেন, ”নিজেকে পরিবর্তন করতে গিয়ে এখন সব পরিচয় আমি হারিয়ে ফেলেছি।”
ফেসবুকের আলোচিত পোস্টটি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে থাকা কূটনীতিকের সাথে কথা বলে বিবিসি বাংলা। বিবিসির কাছে তিনি দাবি করেছেন, যারা তার এই পরিচয় জানতেন, ব্লাকমেইল করেছেন, হয়েছেন যৌন নিপীড়নেরও শিকার।
পরিচয় প্রকাশ করে ফেসবুক পোস্টে তিনি কূটনীতিক চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। এ নিয়ে বিবিসি বাংলা কথা বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবিসি বাংলাকে বলছে, ‘আগে কখনো এমন কোন ঘটনার সম্মুখীন হয় নি মন্ত্রণালয়। বিষয়টি অনেক সেনসিটিভ। যেহেতু এটা আলোচনায় এসেছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরো ঘটনাটি খতিয়ে দেখবে’।
যে কারণে নিজের তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয় তুলে ধরলেন
ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে বন্দর আব্বাসের দূরত্ব প্রায় তেরশো কিলোমিটার। মানব পাচারের রুট হিসেবে পরিচিত এই বন্দর আব্বাস। বাংলাদেশের মানব পাচারের একটি সিন্ডিকেট এই রুটটি ব্যবহার করতো।
বছর চারেক আগে তেহরান দূতাবাসে যোগদানের পর বন্দর আব্বাস রুটের মানব পাচার রোধের দায়িত্ব বর্তায় তার ওপর। সিন্ডিকেট ভাঙতে বন্দর আব্বাসে ওয়ালিদ অভিযান চালান নিয়মিত। সফলও হন।
”এরপরই আমার বিরুদ্ধে সাত-আটটি বেনামি চিঠি পাঠানো শুরু হলো রাষ্ট্রদূতের কাছে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, আমি নাকি প্রভাবশালী ঐ চক্রের কাছে সুন্দরী নারী চাই, না দিলে তাদের বিরুদ্ধে একশন নেই”।
”মোটামুটিভাবে আমার একটা লম্পট চরিত্র দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয় ওইসব বেনামি চিঠিতে। মাফিয়া চক্রের এইসব চিঠির জবাব দেওয়ার মতো কোন উত্তর আমার কাছে ছিলো না। তখন থেকেই নিজের পরিচয় প্রকাশের ইচ্ছে হয়। প্রথমত সে কারণে নিজের পরিচয় উম্মুক্তের ইচ্ছে হয়েছিলো আমার”, বিবিসিকে জানাচ্ছিলেন ওয়ালিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, ”আমার আচরণ একটু ভিন্ন বলে আমাকে নিয়ে না ধরনের কানাঘুষা চলতো। আমি কোন ছেলের সাথে মিশলে তারা ভাবতো আমি মনে হয় যাদের সাথে মিশি তাদের সাথেই যৌন সম্পর্কে জড়াই। পেছনে মানুষ নানা কথা বলতো”।
”কেউ কেউ আবার বাঁকা চোখে দেখতো। এমন অবস্থায় আইডেন্টিটি রিভিল করা আমার জন্য খুব বেশি দরকার ছিলো। এর আর কোন বিকল্প আমার কাছে ছিল না”।
ওয়ালিদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ”অনেকে আমার বিয়ে নিয়ে নানা প্রশ্ন করতো। মানুষ খুব সন্দেহ করতো আমি মনে হয় নপুংসক। এগুলো নিয়ে সমাজে বা আশপাশের লোকজনের নানা কৌতূহল আর প্রশ্নও ছিলো”।
ওয়ালিদ জানাচ্ছিলেন, ”সমাজকে আমি বোঝাতে চেয়েছি তোমরা যেটা চিন্তা করছো আমি সেটা না। যে কারণে দীর্ঘ এত বছর পর হলেও নিজের পরিচয় প্রকাশ করেছি”।

পরিচয় গোপনের যুদ্ধ শুরু যেভাবে
ওয়ালিদ ইসলামের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে। কিন্তু বাবার কাজের সুবাদে তার বেড়ে ওঠা যশোরে। সেখানেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ শেষ করেন।
বিবিসি বাংলাকে ওয়ালিদ বলছিলেন, ”একটু ভিন্ন আচরণের কারণে স্কুল থেকেই আমাকে অনেকে নানা ধরনের নির্যাতন করতো। কেউ পেটাতো, আজে বাজে কথা বলতো, বই খাতা ছিঁড়ে ফেলতো। আমাকে এমন একটা বিষয় ভাবা হতো, যেন এই সমাজে আমার কোন অধিকার নেই”।
”তবে আমার কিছু বন্ধু ছিলো, যারা আমাকে এতটা সাপোর্ট দিয়েছে যে আমি টিকে গেছি”।
ক্লাস সেভেনে তার ওপর ঘটে যাওয়া একটি ভয়াবহ যৌন নিপীড়নের অভিযোগের কথা বিবিসিকে জানান ওয়ালিদ।
অভিযোগে জানান, ”আমার এলাকার একজনের দ্বারা আমি ধর্ষিত হই। তারপর আমার চটপটে জীবন হঠাৎ করে যেন থেমে যায়। ট্রমাটাইজড হয়ে যাই। আমার রেজাল্ট খারাপ হওয়া শুরু হয়”।
একটু একটু স্বাভাবিক হওয়া শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। ওয়ালিদ বলছিলেন, ”পরিচয় ঢাকার জন্য সব সময় আমার পোশাকের দিকে বিশেষ নজর রাখতে হয়েছে”।
স্কুল-কলেজের শিক্ষা জীবন শেষে তিনি ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে। সেখানেই একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে জীবনের বেশ কিছু পরিবর্তনের কথা জানাচ্ছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের এই কূটনীতিক।
প্রেমের সর্ম্পক বনাম পরিচয় সংকট
ছোটবেলা থেকে এক সহপাঠী ওয়ালিদের লিঙ্গীয় পরিচয় সম্পর্কে জানতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে যখন, তখন সেই ছেলে তাকে প্রায়ই ব্লাকমেইল করতেন।
”একদিন ক্যাম্পাসে (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে) ওই ছেলে আমাকে ব্লাকমেইল করে। বাঁধা দেয়ায় সে আমার গায়ে হাত তোলে, মারতে শুরু করে। আমাকে মারতে দেখে ক্যাম্পাসের একটি জুনিয়র ছেলে আমাকে বাঁচায়।”
এরপর থেকে ওই জুনিয়র ছেলের সাথে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেটি প্রেমের সম্পর্কে গড়ায়।
ওয়ালিদ ইসলাম বিবিসিকে বলেন,”ওর সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় আমার বিসিএস চাকরি হয় ফরেন ক্যাডারে। কয়েকটি দেশে চাকরির পর আমি যোগ দেই তেহরানের বাংলাদেশ দূতাবাসে”।
আট বছর প্রেমের সম্পর্কের পর তারা দু’জন বিয়ের পরিকল্পনা করেন। বিয়ের আগে ওয়ালিদ অপারেশন করে ‘ট্রান্স জেন্ডারে’ রূপান্তরের সিদ্ধান্তে নেন।
ওয়ালিদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ”এটাকে কলেস্টমি বলে। অপারেশন ভুল হওয়ায় ফিস্টুলা আক্রান্ত হলাম। তারপর ধরা পড়ে ক্লোন ক্যান্সার।”
”আমাদের বিয়ের তারিখ ছিলো ২০২৩ সালের ৩১শে জানুয়ারি। কিন্তু আমার ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি আমার প্রেমিক ও তার পরিবার জানার পর বিয়ে ভেঙ্গে যায়। আমার কাছে পরামর্শ নিয়েই সেই ছেলে বিয়ে করেছিলো ২০২২ এর নভেম্বরের ১১ তারিখ।”
”আল্লাহ চাননি বলে হয়তো বিয়েও করতে পারিনি, নিজের অপারেশনটাও ঠিকমতো হয় নি। আমি আসলে এলজিবিটিকিউ বা তৃতীয় লিঙ্গের কোন কিছুর মধ্যেই নিজেকে ইনক্লুড করতে পারছি না”, বিবিসিকে বলছিলেন ওয়ালিদ ইসলাম।

মা ও পরিবারের যুদ্ধ
একদম ছোটবেলায় ওয়ালিদের বাবা মারা যান। মা আমিনা বেগম ছোটবেলা থেকেই আগলে রেখেছেন সন্তানকে। আট সন্তানের মধ্যে ওয়ালিদ ছিলেন সবার ছোট।
ওয়ালিদ বলেন, ”আমার মা কিংবা পরিবার মুখ ফুটে কোনদিন একটা বাজে কথাও বলেন নি। আমার পরিবার বিশ্বাস করতে চাইতো না আমি থার্ড জেন্ডার বা হিজড়া। তবে এ কথা শুনেছি সব সমাজের মানুষের কাছ থেকে”।
”এসব ক্ষেত্রে অনেকে হিজড়া পল্লী থেকে নিতে আসে। অনেক বাবা মা সন্তানকে দিতে চায় না। আবার অনেক পরিবার দিয়ে দেয়। অনেকের কাছে সন্তানের চেয়ে সমাজের সম্মান বড়। যেটি আমার পরিবার কোনদিন বুঝতেও দেয়নি’, বলছিলেন ওয়ালিদ।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “আজ যদি আমার মা, আমার ভাই, আমার পরিবার আমাকে আগলে না রাখতেন তাহলে হয়তো হিজড়া পল্লীতে থাকতে হতো আমার। ওরা যেভাবে সমাজে বেঁচে থাকতো, আমার ভাগ্যেও তাই হতো।”
ফেসবুক স্ট্যাটাসের পর যা হচ্ছে
শিক্ষা জীবনের পর পেশাগত জীবনে এসেও পরিচিতদের কাছ থেকে নানা মন্তব্যে মন খারাপ হতো ওয়ালিদের। গত ১০ই জানুয়ারি নিজের পরিচয় প্রকাশ করে একটি স্ট্যাটাস দেন তিনি।
নিজের পরিচয় উন্মুক্ত করে স্ট্যাটাসে ওয়ালিদ লিখেন ”তৃতীয় লিঙ্গের সবাই মানুষ। নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি ক্লান্ত।”
যেখানে নিজেকে বাংলাদেশের ‘প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের ক্যাডার’ এবং ‘বিশ্বের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের কূটনীতিক’ দাবি করেন।
ওয়ালিদ লিখেন ”নিজের সাথে লুকোচুরি করতে করতে আমি ক্লান্ত। এই ভদ্র মানুষের সমাজ আমার জন্য নয়। এই পোস্টটা পড়ে হয়তো সরকারের নির্দিষ্ট কিছু লোক বা সরকার আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, হয়তো চাকরিটাই আর থাকবেনা।”
এই স্ট্যাটাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় তৈরি হয় নানা আলোচনা। সেখানে অনেকের বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করতে দেখা যায়। অনেকেই আবার ওয়ালিদের সাহসিকতার প্রশংসাও করেন।

যা বলছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
ফেসবুক স্ট্যাটাসে চাকরি নিয়ে একটা শঙ্কার কথা বললেও, বিবিসি বাংলাকে ওয়ালিদ ইসলাম বলেছেন, তার এই জেন্ডারের বিষয়টি আগে থেকেই জানতেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতনদের কয়েকজন।
তবে, এর কোন প্রভাব তার চাকরি জীবনে পড়েনি। বরং অনেকেই পাশে থেকে সহযোগিতাই করেছেন তাকে।
স্ট্যাটাসে পরিচয় প্রকাশের পর কোন সংকট হয়নি বলেও জানান তিনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ”আমি তার ওই পোস্টটা দেখেছি। আমি মনে করি, মানুষের বিভিন্ন ধরনের গুণ আছে বা থাকতে পারে।”
তিনি বলেন, “আগে কখনো এমন কোন ঘটনার সম্মুখীন হয়নি মন্ত্রণালয়। বিষয়টি অনেক সেনসিটিভ। যেহেতু এটা আলোচনায় এসেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরো ঘটনাটি খতিয়ে দেখবে।”
শিক্ষাগত সনদসহ সব জায়গায় ওয়ালিদের পরিচয় পুরুষ হিসেবে। ৩৫ তম বিসিএস এ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঢোকেন ওয়ালিদ।
কোন প্রশিক্ষণ ছিলো না, তবুও নিজেই গান লিখেন, ছবি আঁকেন, নিজ হাতে বানান অনেক কিছুই। শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চায় নিজেকে যেভাবে মেলে ধরেছেন, ভবিষ্যতে তা ধরে রাখতে চান।
বিবিসি বাংলাকে আশাবাদ জানিয়ে ওয়ালিদ ইসলাম বলেন, পরিচয় নিয়ে যে সংকট ছিলো, তা কেটে যাবে একদিন।
এই সমাজে একদিন ঘুরে দাঁড়াবেন তিনি। কাজ করবেন সংকটে থাকা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য।
# মুকিমুল আহসান , বিবিসি নিউজ বাংলা, ঢাক,
