চলমান সংবাদ

অনুমোদন না থাকায় “ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল” বন্ধ হলেও “অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হসপিটালস” এখনো কিভাবে চালু আছে?

নিজস্ব প্রতিবেদক
—————-
চট্টগ্রামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্সে “ইমপেরিয়াল হসপিটাল লিমিটেড” থাকা স্বত্বেও হাসপাতালটি অবৈধ ভাবে চলছে “অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হসপিটালস” নামে। জানা গেছে, ২০২২ সাল থেকে ভারতের চেন্নাইইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতাল গ্রুপের সঙ্গে অংশীদারির মাধ্যমে ইমপেরিয়াল হসপিটাল লিমিটেড এর নাম ‘অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হসপিটালস’ রাখা হয়। তবে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় জানায়, অ্যাপোলোর নামটি লাইসেন্সে নেই। এদিকে আমাদের হাতে আসা এক নথিতেও মিলেছে লাইসেন্স অনিয়মের তথ্য৷ নথিপত্রে দেখা গেছে, ‘ইমপেরিয়াল হসপিটাল লিমিটেড’ নামে চলতি বছরের ২২ নভেম্বর লাইসেন্স নবায়ন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যার মেয়াদ রয়েছে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু হাসপাতালটি এখনও চলছে ‘অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হসপিটালস’ নামে।
আরও জানা গেছে, ভারতের অ্যাপোলো হাসপাতাল এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের সঙ্গে ব্র্যান্ড লাইসেন্স ও অপারেশন ম্যানেজমেন্টের চুক্তি করে এবং শুধুমাত্র ‘অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হসপিটালস’ একটি লোগোর অনুমোদন নেওয়া হয়। কিন্তু সব ধরনের লাইসেন্সে নাম পরিবর্তন না করে ‘অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হসপিটালস’ নামে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত করছে প্রতিষ্ঠানটি।
২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর ইমপেরিয়াল হসপিটাল লিমিটেডের নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে সাতদিনের মধ্যে ব্যাখ্যা চেয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দেয় চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন। তখনও নাম পরিবর্তন করেনি হাসপাতালটি। এদিকে দ্বিতীয়বার গত ৩ ডিসেম্বর ২০২৩ খ্রীঃ ফের ১০ দিনের মধ্যে অ্যাপোলো নাম সরিয়ে ফেলার চিঠি পেলেও এখনও নাম পরিবর্তন করেনি হাসপাতালটি। ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর দেওয়া সেই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত ইমপেরিয়াল হসপিটাল লিমিটেডের লাইসেন্স নবায়নের কার্যক্রম আপতত বন্ধ থাকবে। কিন্তু সেই নির্দেশনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ২০২৩ সালের ২২ নভেম্বর ‘ইমপেরিয়াল হসপিটাল লিমিটেড’ নামেই লাইসেন্স নবায়ন করে হাসপাতালটি। কিন্তু হাসপাতালটিতে সাইনবোর্ড, প্রচার-প্রচারণায় এবং ওয়েবসাইটেও অ্যাপোলো নামটি ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে এখনো।
দ্বিতীয় দফায় গত ৩ ডিসেম্বর ২০২৩ খ্রীঃ হাসপাতালটির বিরুদ্ধে লাইসেন্সের শর্তভঙ্গের অভিযোগ এনে চিঠি দেয় চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন। ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে আগামী ১০ দিনের মধ্যে অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হসপিটালস নাম যুক্ত সমস্ত সাইনবোর্ড, প্রচারপত্র ও অফিসিয়াল দস্তাবেজ অপসারণ করার জন্য সময় দেওয়া হয়। অন্যথায় বিধিমতো ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয় চিঠিতে। দ্বিতীয় দফায় দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল লিমিটেডের কার্যক্রম অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হসপিটালস নামে পরিচালিত হচ্ছে। প্রথমত ভিন্ন নামে কার্যক্রম পরিচালনা বিধি পরিপন্থি এবং বিভ্রান্তিকর। দ্বিতীয়ত যেহেতু চিকিৎসাসেবা স্পর্শকাতর বিষয়। বিধিমতে নাম পরিবর্তন ব্যতিরেকে সকল বিলবোর্ড, বিজ্ঞাপন, অফিসিয়াল প্যাড, পত্র যোগাযোগ, সর্বক্ষেত্রে লাইসেন্স অনুযায়ী ইমপেরিয়াল হসপিটাল লিমিটেড নামে পরিচালনা একান্ত অপরিহার্য ও বিধিসম্মত। চিঠিতে আরও বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক ইস্যুকৃত ইমপেরিয়াল হসপিটাল লিমিটেড ব্যতীত অন্য কোনো নাম সংযোজন-বিয়োজন করে স্থাপিত বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, বিজ্ঞাপন, অফিসিয়াল প্যাড, পত্র যোগাযোগ ইত্যাদি অনিয়মতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড আগামী ১০ দিনের মধ্যে অপসারণ ও লাইসেন্সের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো। সেবা গ্রহীতাগণ প্রতারণা ও বিভ্রান্তির সম্মুখীন না হওয়া এবং জনস্বার্থে উপরোক্ত নির্দেশনা আবশ্যিকভাবে প্রতিপালনের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হলো। অন্যথায় বিধিমতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শুধু মাত্র লোগো অনুমোদন নিয়ে অ্যাপোলো নাম ব্যবহার এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমপেরিয়াল হাসপাতালের ২৬.১০.২০২২ তারিখের চিঠি সিভিল সার্জন মেনে নেয়নি। তাই সিভিল সার্জন ০৩.১২.২৩ তারিখ অ্যাপোলো নাম ব্যবহার না করার জন্য আবার চিঠি দিয়েছে। কিন্তু ইমপেরিয়াল হাসপাতাল এখনো অ্যাপোলোর নাম ব্যবহার করছে।
কিন্তু কোন অদৃশ্য শক্তির কারনে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে দু’বার চিঠি দেওয়ার পরও কেন ‘অ্যাপোলো’ নামটি সরায়নি চট্টগ্রাম নগরীর ইমপেরিয়াল হসপিটাল লিমিটেড, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সিভিল সার্জন এর নির্দেশনা উপেক্ষা করে ভারতের অ্যাপোলো হসপিটালস এর নাম ব্যবহার করার মাধ্যমে উক্ত হাসপাতাল সেবা গ্রহীতাগণের সাথে প্রতারণা করছে বলেই প্রতিয়মান। জানা গেছে ভারতের অ্যাপোলো হসপিটালস এর নাম ব্যবহার করলেও সেখানে ভারতের অ্যাপোলো হসপিটালস এর কোন চিকিৎসক নেই। মূলত ভারতীয় অ্যাপোলো হসপিটালস এর নাম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে ব্যবসা করাই এর উদ্দেশ্য।
কিন্তু ঢাকায় স্বাস্থ্য আধিদপ্তরের লাইসেন্সের আবেদন পত্রে “ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল” না থাকায় হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঢাকার সাতারকুলে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে “ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল” নাম নিয়ে চলছিল ইউনাইটেড গ্রুপের একটি হাসপাতাল, যা ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ এর সাথে সম্পৃক্ত। সম্প্রতি উক্ত হাসপাতালে সুন্নতে খৎনা করাতে গিয়ে শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণে জানা যায় হাসপাতালটি “ইউনাইটেড হেলথকেয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড” নামে নিবন্ধনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেছে, যা এখনো প্রক্রিয়াধীন আছে। অর্থাৎ “ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল” নামের কোন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদনই করা হয়নি, অথচ এই নাম নিয়েই উক্ত হাসপাতাল ২০২০ থেকে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য উক্ত হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজটি নির্মানাধীন ভবনেই কাজ শুরু করেছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এর মতে “ইউনাইটেড হেলথকেয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড” এর নামের স্থলে “ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল” নাম ব্যবহার আইনত বৈধ নয়। আয়ানের মৃত্যুর ঘটনার পর গত ১০ই জানু ২০২৪ খ্রীঃ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাসপাতালটি পরিদর্শন কালে নিবন্ধন সংক্রান্ত এই গলদ ধরা পরায়, গত ১৪ই জানু ২০২৪ খ্রীঃ এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাসপাতালটির কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিবন্ধন/লাইসেন্স প্রাপ্ত না হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করায় দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ অনুযায়ী ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতাল, ইউনাইটেড সিটি, সাতারকুল, বাড্ডা, ঢাকা নামক প্রতিষ্ঠানটির সকল কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধের আদেশ প্রদান করা হলো।
প্রশ্ন হল, কোন অদৃশ্য শক্তির বলে ২০২০ সাল থেকে অনুমোদোনহীন ভাবে চলছিল “ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল” তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন নয় কি? এই ধরনের কর্পোরেট হাসপাতাল গুলোর ব্যপারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রশাসন কেন নিশ্চুপ থাকে? আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে যেনতেন প্রকারে হাসপাতাল চালু করে জবাদিহিতাহীন ভাবে চিকিৎসা পরিষেবার নামে যেমন খুশী ব্যবসা করাই যেন এদের উদ্দেশ্য। এদের বিশাল পুঁজির কারনে ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানান সুযোগ সুবিধা পাওয়ার কারনে, প্রশাসন থেকেও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া কঠিন। সব চেয়ে দুঃখজনক হল কোন একটা দুর্ঘটানা ঘটার পর প্রশাসনের টনক নড়ে, অথচ তাদের নাকের ডগায় বসে এই সব মাল্টিমিলিওনিয়ররা যখন অবৈধ কাজ করতে থাকে তখন প্রশাসন থাকে নিশ্চুপ। এই ধরনের অবৈধ ও অনুমোদোনহীন সব হাসপাতাল অনতিবিলম্বে বন্ধের উদ্যোগ নেয়া উচিৎ এতে ভবিষ্যতে জবাবদিহিতা থাকবে ও দুর্ঘটনাও কমবে।