আন্তর্জাতিক শ্রমমান অনুসারে কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরনের মানদন্ড নির্ধারন কর: জাহাজভাঙা শ্রমিক সেফটি কমিটি
জাহাজভাঙা শ্রমিক সেফটি কমিটির উদ্যোগে গতকাল ৩০ ডিসেম্বর শনিবার বিকাল ৩টায় আন্তর্জাতিক শ্রমমান তথা আইএলও কনভেনশন ১০২ ও ১২১, মারাত্মক দুর্ঘটনা আইন ১৮৫৫ এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসারে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহত-আহতের ক্ষতিপূরনের মানদন্ড নির্ধারন এবং পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরনের দাবিতে চট্টগ্রামের জামাল খানস্থ প্রেস ক্লাব চত্বরে এক মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাহাজভাঙা শ্রমিক সেফটি কমিটির আহ্বায়ক এডভোকেট জহির উদ্দিন মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সমাবেশ যৌথভাবে সঞ্চালনা করেন বিল-ডিটিডিএ সেন্টার কো-অর্ডিনেটর ফজলুল কবির মিন্টু এবং সেফটি কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব মোঃ ইদ্রিছ।
সমাবেশে বক্তব্য প্রদান করেন, জাহাজভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা তপন দত্ত, ফোরামের সদস্য মছিউদ দৌলা, সেফটি কমিটির সদস্য সচিব মোঃ আলী, কে এম শহিদুল্লাহ, সেফটি কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক দিদারুল আলম চৌধুরী, আব্দুর রহিম মাস্টার, মোঃ ইকবাল হসেন, মানিক মণ্ডল প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরন এবং পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়টি সার্বজনিন মানবাধিকার ঘোষণা এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তিতে অধিকার হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এই অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজন নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মক্ষেত্র , পেশাগত রোগের উপর নিয়ন্ত্রন, স্বাস্থ্য সেবার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং একই সাথে দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে নির্ভশীলদের আয়ের নিশ্চয়তা বিধান করা যাতে কর্মক্ষেত্রে আহত নিহতের নির্ভরশীলরা কোন ধরনের অনাকাংখিত আর্থিক সংকটের মুখোমুখি না হন।
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এবং পেশাগত রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বেশ কয়েকটি কনভেনশন এবং রিকমেন্ডেশান গ্রহন করেছে। আইএলও কনভেনশন ১০২ ও ১২১ অনুসারে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা পেশাগত রোগের নেতিবাচক প্রভাবে যদি কোন শ্রমিক স্থায়ীভাবে বা আংশিকভাবে কর্মঅক্ষম বা উপার্জন করতে অক্ষম হয়ে পড়ে তবে তার দায় নিয়োগকর্তাকে বহন করতে হবে। কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা বিধানকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে এবং কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে যা যা করনীয় তা অক্ষরে অক্ষরে এবং শতভাগ পালন করতে হবে। ১০০ ভাগের মধ্যে ১ ভাগ অনিরাপদ হলেও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা থেকে যায়। তাই কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে ন্যুনতম অবহেলার কোন সুযোগ নাই। নেতৃবৃন্দ আইএলও কনভেনশন ১০২ ও ১২১, মারাত্মক দুর্ঘটনা আইন ১৮৫৫ এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরনের মানদন্ড নির্ধারন এবং পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে কঠোর আইন প্রণয়ন করে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জোর দাবি জানান।
নেতৃবৃন্দ বলেন, বর্তমান শ্রম আইনে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা, জাহাজভাঙা শ্রমিকদের জন্য জাহাজ পুনঃ প্রক্রিয়াজাতকরণ বিধিমালা ২০১১ এবং আঞ্চলিক ক্রাইসিস কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক আরো ৫ লক্ষ টাকাসহ জাহাজভাঙা শ্রমিকেরা কর্মক্ষেত্রে নিহত হলে ৭ লক্ষ টাকা পাওয়ার বিধান রয়েছে। অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে স্থায়ী পঙ্গু হয়ে গেলে ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান আছে যা খুবই অপ্রতুল এবং বর্তমান বাজার দরের সাথে নিতান্তই অসংগতিপূর্ণ। তারা আইএলও কনভেশন ১০২ ও ১২১ অনুসারে নিহতদের আজীবন আয় এবং স্থায়ী পঙ্গুদের আজীবন আয় ও ভোগান্তি হিসাব করে ক্ষতিপূরনের মানদন্ড নির্ধারনের দাবি জানান।
সভায় উল্লেখ করা হয়, জাহাজভাঙা শিল্পে ২০১৫ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ৯ বছরে ১২২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছে এবং ২০২৩ সালে ৩৬টি দুর্ঘটনায় ৭ জন শ্রমিক নিহত এবং ৩০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। বিগত বছরগুলোতে লক্ষ করা গেছে জাহাজভাঙা শিল্প ছাড়াও সারা দেশে কর্মক্ষেত্রগুলোতে কাজ করতে গিয়ে প্রতি বছর সহস্রাধিক শ্রমিক নিহত হয় এবং আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করা শ্রমিকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। অর্থাৎ এক চরম অনিরাপদ কর্ম্পরিবেশে আমাদের দেশের শ্রমিকরা কাজ করছে।
আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, একজন শ্রমিক নিহত বা আহত হওয়ার অর্থ হচ্ছে একটি শ্রমিক পরিবার আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হয় যা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। এধরনের অনিশ্চিত ও অনিরাপদ কর্ম পরিবেশ টেকসই শিল্পের জন্যও ভাল উদাহরন হতে পারেনা। তাই কর্মস্থলের সকল ধরণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং প্রয়োজনে বর্তমান শ্রম আইন সংশোধন করে আরো কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হরে। কর্মক্ষত্রে দুর্ঘটনায় মালিক পক্ষ এবং রাষ্ট্রের শ্রমখাত সংশ্লিষ্ট দপ্তর সমূহের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।