নিবন্ধন বাতিলের আদেশ বহাল, নির্বাচন নিয়ে কী চিন্তা জামায়াতে ইসলামীর?
রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ বলে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল রোববার খারিজ করে দিয়েছে আপিল বিভাগ।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বিবিসিকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানিয়েছেন, আদালতে আপিলকারীর পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আদালত আপিলটি খারিজ করে দেয়।
এই আদেশের ফলে এখন জামায়াতে ইসলামী দলীয়ভাবে কিংবা দলীয় প্রতীক নিয়ে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।
বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী, রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন না থাকলে কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না।
তবে সংগঠন হিসেবে সক্রিয় থাকতে পারে দলটি।
রায়ের পর জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এই রায়ের মাধ্যমে ‘ন্যায়বিচার বঞ্চিত’ হয়েছে তার দল।
এই রায়ের পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ কী হতে পারে সে সম্পর্কে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরে জানানো হবে বলে জানিয়েছেন জনাব আকন্দ।
তাহলে নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে দলটি?
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে দলটি?
রোববার আদালতের রায়ের পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তাহলে নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে?
এছাড়া দলীয়ভাবে কিংবা দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারেই বা তাদের বক্তব্য কী?
জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক জনাব আকন্দ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “নিবন্ধন (নিয়ে) হাইকোর্টের রায়টা বহাল রাখার কারণে, আইনগতভাবে (দলীয় প্রতীকে) এখন নির্বাচন করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর যেকোন নেতা যে কোন কর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। তাতে কোন সমস্যা নেই।”
“আর দল যখন নিবন্ধন পাবে আবার তখন দলীয় প্রতীকেই নির্বাচনে যাবে জামায়াতে ইসলামী,” বলেন তিনি।
তবে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী অংশ নেবে কীনা সে বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলেননি তিনি।
এদিকে, ১৫ই নভেম্বর বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে।
তফসিল ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে ইতিমধ্যে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু করেছে।
তবে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি জানিয়ে দিয়েছে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না।
এদিকে, বিএনপির এক সময়ের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির সাথে তাল মিলিয়ে ধারাবাহিকভাবে সব কর্মসূচিতে সমর্থন দেয়া এবং একই কর্মসূচি দিলেও, নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার কোন বক্তব্য দেয়নি।
রোববারের সংবাদ সম্মেলনে জনাব আকন্দ বলেছেন, বাংলাদেশে ২০১৪ এবং ২০১৮ ছাড়া সব নির্বাচনে অংশ নিয়েছে জামায়াত।
এর আগে দলটির নেতৃবৃন্দ বিবিসিকে বলেছিলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে তাদের।
তবে, জামায়াতে ইসলামীর অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল আলিম বিবিসি বাংলাকে সে সময় বলেছিলেন,”নির্বাচনে অংশ নেয়ার পরিবেশ তৈরি হলে, নিবন্ধন না থাকলেও বিকল্প পন্থায় এতে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি রয়েছে তাদের।”
তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন মুখী দল, ফলে নির্বাচনী প্রস্তুতি তাদের নিয়মিত কাজের অধীনেই পড়ে।
জনাব আলিম বলেছেন, শুধু সরকারের পতন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতেই আন্দোলন করছেন না তারা। বরং বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার যাতে ফিরিয়ে আনা যায়, সেটাই তাদের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য।
কী বলছেন বিশ্লেষকেরা?
তবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনুষ্ঠানিক অবস্থান না প্রকাশ করলেও, নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের হয়তো ‘বিকল্প চিন্তা’ আছে, যে কারণে সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে আন্দোলন করছে তারা।
জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির পর্যবেক্ষক ও দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সালাউদ্দিন বাবর বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তিনি মনে করেন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন থাকুক আর নাই থাকুক, আগামী নির্বাচনে যাওয়াটা স্থির করে রেখেছে তারা। এজন্য সব ধরণের বিকল্প তাদের হাতে রেখেছে দলটি।
তিনি বলেছেন, “জামায়াতের বিকল্প ভাবনার মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাও হতে পারে, আবার বর্জনও হতে পারে। তবে যে সিদ্ধান্তই নেয়া হবে সেটি পরিবেশ-পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে।”
সেক্ষেত্রে ‘নির্বাচন জানুয়ারিতে হলে সেটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে কিনা, সে বিষয়টির উপর সব কিছু নির্ভর করবে’ বলেও মনে করেন তিনি।
সালাউদ্দিন বাবর বলেন, “জামায়াতের বিকল্প পন্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে- তারা নতুন দল গঠন করতে পারে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।”
আর ‘যদি’ দেশে ‘নির্বাচনী পরিবেশ’ তৈরি হয় এবং জামায়াতের মিত্ররা যদি নির্বাচনে যাওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তারা নির্বাচনে যাওয়া-না-যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে পারে।
তিনি বলেন, “একটা নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হলে তারা একটা নতুন দলও করতে পারে। আবার জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে তারা অন্য ধরণের কোন নেগোসিয়েশনে (সমঝোতায়) যেতে পারে।”
জামায়াতের জন্য যে বিকল্প সবচেয়ে ভালো ও সুবিধাজনক হবে সেটিই তারা বেছে বলে মনে করেন তিনি।
তবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, বিএনপির প্রতিপক্ষ হিসেবে জামায়াতকে মাঠে রাখার আওয়ামী লীগের একটা চেষ্টা থাকতে পারে।
আর হয়ত এ কারণেই গত ২৮শে অক্টোবর অনুমতি না পেলেও কোন বাধা ছাড়াই সমাবেশ করতে পেরেছে দলটি, বলছেন জনাব আহমদ।
এর আগে ২০১৩ সালের পহেলা আগস্ট হাইকোর্ট এক রায়ের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ বলে রায় দেয়।
এরপর ২০১৮ সালের আটই ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছিল জামায়াতে ইসলামী।
তার ওপর শুনানির তারিখ নভেম্বর মাসেই দুই দফা পেছানোর পর আজ ১৯শে নভেম্বর সেটি খারিজ করে দিয়েছে আদালত।
তবে প্রায় এক দশক প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকার পর এ বছর ১০ই জুন ঢাকায় সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী।
সেখানে তারা বেশ কয়েকটি দাবি তুলে ধরে – যার অন্যতম হচ্ছে, দলটির নিবন্ধন ফিরিয়ে দেয়া, জামায়াতের নেতাদের মুক্তি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন।