ডিমের দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার, কত করে পড়বে ডজন?

প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে ডিমের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। খুচরা বাজারে প্রতিটি ডিমের দাম সর্বোচ্চ ১২টাকা করে নির্ধারণ করে দেয়ার কথা জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি।
এর ফলে খুচরো বাজারে ব্যবসায়ীরা ডজনপ্রতি ডিমের দাম ১৪৪ টাকার বেশি নিতে পারবেন না।
একইসঙ্গে নির্ধারিত মূল্যে ডিম বিক্রি করা না হলে ডিম আমদানি করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বুধবার কৃষিপণ্যের মূল্য পর্যালোচনা সংক্রান্ত একটি সভার পর বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ডিম, আলু ও দেশি পেঁয়াজের দাম বেঁধে দেন।
এসময় বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমাদের নির্ধারিত ডিমপ্রতি ১২ টাকা বিক্রির সিদ্ধান্ত যদি ঠিক থাকে তাহলে আমদানি করা হবে না।
আর যদি ব্যবসায়ীরা তা না মানেন তবে ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে ডিম আমদানির অনুমতি চেয়ে ব্যবসায়ীদের আবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা আছে বলেও জানান বাণিজ্য মন্ত্রী।
মন্ত্রী বলেন, উৎপাদন খরচ হিসাব করে দেখেছি ডিম, আলু ও পেঁয়াজ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সে জন্য আমরা কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে এই দাম নির্ধারণ করেছি।
ডিমের বাজারে অস্থিরতা

বেশ লম্বা সময় ধরেই ডিমের বাজারে অস্থিরতা চলছে।
চলতি বছরের আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে এক ডজন ডিমের দাম ১৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা পর্যন্ত হয়েছিল।
আর এর কারণ হিসেবে ‘সিন্ডিকেটের’ মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের আলোচনাও আছে দীর্ঘদিন ধরেই।
তবে এবার এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি)।
কারসাজির মাধ্যমে ডিমের বাজারে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি করে বাড়তি মুনাফা করায় ৬টি কোম্পানি ও ৪টি বাণিজ্যিক অ্যাসোসিয়েশনের (সমিতি) বিরুদ্ধে মামলা করেছে এই কমিশন।
কয়েকটি স্থানীয় গণমাধ্যমে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় কাজী ফার্মসে লিমিটেডর নাম এলেও এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের পর কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে এ সংক্রান্ত কোন নোটিশ পাননি বলে জানান আরেক অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিআইএ) মহাসচিব খন্দকার মুহাম্মদ মহসিন।
তবে মামলা চলমান থাকায় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেনি বিসিসি।
মামলা করার কারণ

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। বাজারে সমতার মাধ্যমে ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষা করতে কাজ করে এই কমিশন।
প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ এর অধীনে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জোটবদ্ধতা ও ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশে বাজার নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ প্রণয়ন করা হয়।
প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘনের জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর তদন্ত, বিচার ও শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই কমিশন। ফলে আদালতে না গিয়ে মামলা নিষ্পত্তির সুযোগ থাকে।
ডিমের দামবৃদ্ধির কারসাজির প্রাথমিক তথ্য পাওয়ার পর সরেজমিনে অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের (বিসিসি) সদস্য মো. হাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, “অনুসন্ধানের পর জমা দেয়া প্রতিবেদনে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পর কমিশন মামলার সিদ্ধান্ত নেয়”।
তবে ‘সিন্ডিকেটকে’ ডিমের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে মানতে নারাজ বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিআইএ) মহাসচিব ও ইউনাইটেড এগ সেল পয়েন্ট এর স্বত্বাধিকারী খন্দকার মুহাম্মদ মহসিন।
বরং সাম্প্রতিক সময়ের অস্বাভাবিক গরম, প্রান্তিক পর্যায়ে খামারীদের লোকসান এবং সামগ্রিক বাজারের যে চাপ ডিমের ওপর পড়েছিল তা থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগছে বলেই ডিমের দাম বাড়তি বলে মন্তব্য করেন এই ব্যবসায়ী।
এমনকি ভারতের ডিমের দামের সঙ্গে বাংলাদেশের ডিমের দামের তুলনাও ‘ভুল’ বলে উল্লেখ করে মিঃ মহসিন বলেন, “মেশিনারিজ সুবিধার কারণে আ ৩৮০টি ডিম উৎপাদনে যে খরচ হয় তা দিয়ে তারা ৫০০টি ডিম উৎপাদন করতে পারে”।
এছাড়া অন্যান্য খাতের পণ্য আমদানির চিত্র তুলনা করে আমদানির মাধ্যমে সাময়িকভাবে বাজারে দাম কমানো গেলেও দীর্ঘ সময় এর থেকে লাভবান হওয়া সম্ভব না বলে মনে করেন তিনি।
তদন্ত প্রক্রিয়া
বাজারে হঠাৎ অস্থিরতা তৈরি হওয়ার কারণ জানতে প্রতিযোগিতা কমিশন একটি তদন্ত দলকে সরেজমিন অনুসন্ধানে পাঠায়।
এসময় এর সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী, ক্রেতা-বিক্রেতাসহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে তদন্ত দল আলাপ করে এবং স্টক থেকে শুরু করে, বিক্রির দামসহ সার্বিক পরিস্থিতির খোঁজ নেয়।
এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ডিমের দামবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম উঠে এসেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকে মামলা করা হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

অপরাধ প্রমাণিত হলে কী শাস্তি হবে?
বাজার কারসাজির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২ এর ধারা ১৫(১), ১৫(২)(ক)(অ), ১৫(২)(খ) ও ১৫(২)(গ) ধারা অনুযায়ী অভিযোগ দায়ের করে মামলা করা হচ্ছে।
এই আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিযোগিতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে বা বাজারে একচেটিয়া প্রভাব তৈরি করবে এমন কোন পণ্য বা সেবার উৎপাদন, সরবরাহ, বিতরণ, মজুত বা অধিগ্রহণে কেউ কোনো চুক্তি বা যোগসাজশ করতে পারবেন না।
আইন অনুযায়ী কারসাজি করে ডিমের দাম বাড়ানোর অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয় তাহলে তিন বছর ওই প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক টার্নওভারের ১০% পর্যন্ত আর্থিক জরিমানা করা হতে পারে। অথবা অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে যে মুনাফা করেছে, তার তিন গুণ জরিমানাও হতে পারে।
এছাড়াও সভায় দেশি পেঁয়াজ ও আলুর দাম বেঁধে দেয়া হয়েছে বলে জানান বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি। বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী, আলু খুচরা পর্যায়ে ৩৫-৩৬ টাকা (হিমাগার পর্যায়ে ২৬-২৭) এবং দেশি পেঁয়াজের দাম হবে ৬৪-৬৫ টাকা।
# বিবিসি বাংলা নিউজ