কমিউনিটি সেন্টার বয়রা যেন আধুনিক যুগের দাস শ্রমিক? -ফজলুল কবির মিন্টু
কিছুদিন পূর্বে চট্টগ্রামের কিছু কমিউনিটি সেন্টার বয়দের সাথে এক অনুষ্ঠানে মিলিত হয়েছিলাম। তারা প্রত্যেকেই চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর ডেকোরেটার্স ও কমিউনিটি সেন্টার শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা ও কর্মী। কুশল বিনিময়ের পর পরই তারা বলতে শুরু করলেন তাদের মনের গভীরে জমে থাকা কষ্টের কথা, বঞ্চনার নানান গল্প। আমি গভীর মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম আর ভাবছিলাম যে মানুষগুলো আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাসিমুখে খাবার পরিবেশন করে –দেশের সিংহ ভাগ অনুষ্ঠান যাদের ভুমিকা ছাড়া সফল হবে কিনা সন্দেহ আছে -তাদের হৃদয়ের গভীরে কী নিদারুণ কষ্ট -তা কী আমরা কখনো জানার বা বুঝার চেষ্টা করেছি?
কমিউনিটি সেন্টার বয়রা যেন আধুনিক যুগে অবস্থান করেও সেই প্রাচীনকালের অন্ধকার যুগের দাস প্রথার ভাগ্য বিড়ম্বিত ও হতভাগ্য মানব গোষ্ঠীর এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি?
আমি ৮০’র দশকের মাঝামাঝি সময় হতে ৯০’র দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম। পরবর্তীতে পেশাগত জীবনে হিসাব রক্ষক, কম্পিউটার প্রোগ্রামার এবং সবশেষে মানব সম্পদ বিভাগে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমার দীর্ঘ পেশাগত জীবনে শ্রমজীবী মানুষের দুঃখকষ্ট অনেক কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। সাধারণভাবে বাংলাদেশের সকল গরীব এবং মেহনতি মানুষ নানান ভাবে বঞ্চনা আর শোষনের শিকার। এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু কমিউনিটি সেন্টার বয়দের সাথে কথা বলে জানা গেল তাদের বঞ্চনা আর শোষনের মাত্রা যেন অন্যান্য শ্রম খাতের শ্রমিকদের তুলনায় শতগুন বেশি। তারা শুধু বঞ্চনা আর শোষনের শিকার হচ্ছে তাই নয় –প্রতিনিয়ত আত্মসম্মানবোধকেও জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হচ্ছে শুধুমাত্র জীবন ও জীবীকার প্রত্যাশায়।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে কমিউনিটি সেন্টার বয়দের আন্দোলনের ফলে তাদের দৈনিক মজুরি ৩৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৪০০ টাকা করা হয়েছে। কিন্তু ৫০ টাকা বৃদ্ধি যেন মালিক পক্ষের কোনভাবেই সহ্য হচ্ছে না। তাই পূর্বে যেখানে প্রত্যেক অনুষ্ঠানে ৪ থেকে ৫ ব্যাচে অতিথিদের খাওয়ানো সম্পন্ন হতো – সেখানে বর্তমানে নাকি অনুষ্ঠান শেষ করতে ৬/৭ ব্যাচ কিংবা কখনো কখনো ৮ ব্যাচও প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ দৈনিক ৫০ টাকা বৃদ্ধির কারণে বয়দেরকে দিয়ে প্রায় দ্বিগুন কাজ করানো হচ্ছে। এরপর অনুষ্ঠান শেষে অতিথিরা চলে যাওয়ার পর তাদের দিয়ে পুরো কমিউনিটি সেন্টার ধোয়া-মোছা ও পরিস্কার করানো হয় অথচ এরজন্য তারা কোন অতিরিক্ত মজুরিও পায়না। এতকিছুর পরেও তারা মাসে সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার বেশি মজুরি পায়না। এ দুর্মূল্যের বাজারে এত অল্প আয় দিয়ে কীভাবে চলে জিজ্ঞাসা করেছিলাম –উত্তরে তারা জানালো যেদিন অনুষ্ঠান থাকেনা সেদিন যে ধরনের কাজের অফার আসে সব কাজই তারা করে থাকে। একজন জানালো তাদের যখন কোন কাজ থাকেনা তখন স্যুইপারের কাজ করতে বললে সেটাও তারা করে থাকেন। কারন যেকোন উপায়ে আয় করতে হবে। আর যেদিন আয় থাকেনা সেদিন তাদের পরিবারের সদস্যদের না খেয়েই থাকতে হয়।
তাদের কেউ কেউ বলতে থাকেন -নিজে না খেয়ে থাকা যায় কিন্তু বউ বাচ্চাদেরতো উপোস রাখা যায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্য রাত-দিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেও কমিউনিটি সেন্টার বয়দের পরিবার পরিজনের ভাগ্যে দুবেলা দুমুঠো ভাতও সব সময় জুটেনা। অথচ তাদের শ্রমের উপর ভর করেই গড়ে উঠছে সারা দেশে অসংখ্য বড় বড় বিলাস বহুল কমিউনিটি সেন্টার। একদিকে কমিউনিটি সেন্টারগুলো বিলাস বহুল হচ্ছে আর অন্যদিকে সেই কমিউনিটি সেন্টার গুলোতেই কাজ করে, না খেয়েই শুকিয়ে মরছে কমিউনিটি সেন্টার বয়রা এবং বয়দের পরিবার পরিজন। এ যেন প্রদীপের নীচে অন্ধকার কিংবা একই যাত্রায় দুই ফল।
শ্রম আইন বিশ্লেষণ করে বলা যায় কমিউনিটি সেন্টার একটি সেবামূলক শিল্প খাত। সুতরাং এ খাতে কর্মরত সকল শ্রমিকই প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক হিসাবেই স্বীকৃতি পাওয়া উচিৎ। সারা দেশে অজস্র বড় বড় বিলাস বহুল কমিউনিটি সেন্টার আছে কিন্তু ওই সকল কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে একজনও স্থায়ী শ্রমিক নাই। কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে কর্মরত বয়দের কোন দায় দায়িত্ব মালিকরা নেয়না। ফলে প্রতি নিয়ত অনিশ্চিত জীবনের মাঝেই তাদের বসবাস।
রমজান মাস সন্নিকটে। ৩০ দিন রোজা রাখার পর দেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠী মুসলিম সম্প্রদায় ঈদ উৎসব পালন করবে। সবাই যখন ঈদের আনন্দ উৎসব করার জন্য প্রস্তুতি নিবে তখন আমাদের কমিউনিটি সেন্টার বয় শ্রমিকদের দিন কাটবে আতংকের মধ্যে। কারন রমজান মাসে দেশে কোন বিয়ে সাদী কংবা অন্য বিশেষ কোন অনুষ্ঠান হয় না। ফলে কমিউনিটি সেন্টার বয়রা পুরো রমজান মাস ব্যাপী আয়শূন্য থাকে। দেশের সর্ববৃহৎ উৎসব তাদের কাছে বিস্বাদে পরিনত হয়। সারা বছর নাহোক শুধু রমজান মাস এবং ঈদের সময় যদি মালিকরা শ্রমিকদের দায় নিতো তাহলেও হয়তো কমিউনিটি সেন্টার শ্রমিকেরা কিছুটা শান্তনা পেত।
শ্রমিকের দায়িত্ব না নিয়ে, মজুরি না দিয়ে কিংবা কম মজুরি দিয়ে আপাত দৃষ্টিতে মালিকের মুনাফা কিছুটা বেশি হয়তো হয়। কিন্তু এধরনের মনোভাব টেকসই শিল্পের জন্য ক্ষতিকর। আশা করি বিষয়টা কমিউনিটি সেন্টার মালিক ও রাস্ট্রের কর্ণধারগন উপলদ্ধি করতে সক্ষম হবেন।
লেখকঃ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক